ঢাকা থেকে বেনাপোলে বাস যায় বেশ কয়েকটি। হানিফ, শ্যামলী, দেশ ট্রাভেলস, ঈগল সহ আরো কয়েকটি বাস আছে । আমরা হানিফে গিয়েছিলাম । ২১ তারিখ রাত ১০.১৫ তে ছিলো আমাদের বাস । আমরা রাত ৯.৩০ এর মধ্যেই কল্যাণপুরে হানিফের নির্ধারিত কাউন্টারে গিয়ে হাজির হলাম । আমি গিয়ে দেখি তাসিন বিশাল বড় একটা লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । আমি ওর লাগেজ দেখে পুরো আবুল হয়ে গেছি । এই বিশাল লাগেজ নিয়ে এই ব্যাটা ক্যামনে ট্যুর দেবে আল্লাহ মালুম । এই লাগেজে নাকি ওর সব শীতের কাপড় । রাগে আমি কিছুক্ষণ নিজে নিজেই ফোঁৎ ফোঁৎ করলাম । এরপর নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিলাম যে ওর জিনিস ও ক্যারি করবে আমার কি । সেলিম এসেছিলো আমাদের বিদায় জানাতে । ওকে বিদায় জানিয়ে আমরা বাসে চেপে বসলাম । নির্ধারিত সময়ে বাস কাউন্টার থেকে ছেড়ে গেলো । আমরাও আড্ডা দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে ।
বেনাপোল বর্ডার অতিক্রম- (২২-০৩-১৮)
ভোর সাড়ে ছয়টা নাগাদ আমরা গিয়ে পৌঁছলাম বেনাপোলে । কেউ যদি দ্রুত বর্ডার পার করতে চায়, তাহলে তাকে আরো আগে ঢাকা থেকে প্রস্থান করার জন্য বলা হলো । আর এই রুটে ফেরির কারণে কত সময় লাগবে, তা নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারবে না । যাহোক, সেখানে বাসে থেকে নেমে অটো নিয়ে সোজা চলে গেলাম কাস্টমস অফিসে । কাস্টম অফিসে গিয়েই দেখি দালালদের ছড়াছড়ি । দশ টাকার বিনিময়ে তারা এরাইভাল কার্ড পূরণ করে দিচ্ছে ।
বর্ডারে দালাল এর কাছে ধরা দেবো না, এই নিয়ত করে বেড়িয়েছি – যা থাকে কপালে । অফিসের প্রবেশে ফি দিয়ে সোজা ঢুকে গেলাম ভেতরে । এরপর গিয়ে দাঁড়ালাম ট্রাভেল ট্যাক্সের লাইনে । সেখানেও দেখি বিশাল লাইন । অনেক কষ্টে ট্রাভেল ট্যাক্স জমা দিলাম । এরপরে ইমিগ্রেশন অফিসে গিয়ে এরাইভাল কার্ড সংগ্রহ করে নিজেরাই পূরণ করে জমা দিলাম । সেখান থেকে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে প্রথমবারের মতো পা রাখলাম নো ম্যান্স ল্যান্ডে । এরপর সেখান থেকে প্রথমবারের মতো পা রাখলাম ইন্ডিয়ার সীমানাতে । ওখানেও এই ফরম পূরণের জন্য দালালরা বসে গেছে । নিজেরাই সেই ফরম ফিলাপ করলাম । ভারতের ফর্মে যে হোটেলে থাকতে চান তার নাম উল্লেখ করতে হয় । সুতরাং আগে থেকেই একটা হোটেলের নাম ঠিক করে নিয়ে যাবেন যদি দালাল দিয়ে না করাতে চান । আসল কথা হলো এসব কিছু আসলে চেক করা হয় না । হুদাই একটা ফরমালিটিস মাত্র । কেউ চাইলে দশ টাকা দিয়ে দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশ বা ভারতের এন্ট্রি ফরম ফিলাপ করাতে পারেন । ওটা ফিলাপ করতে ওরকম উত্তেজনার একটি মুহূর্তে বেশ পেইন মনে হচ্ছিলো ।
এরাইভাল কার্ড
রপর বিশাল লাইন কাভার করে ভারতের ফরমালিটিস শেষ করতে করতে সবমিলিয়ে প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে গেলো ।চারজনে তখন প্রথমবারের মতো ইন্ডিয়াতে, প্রথমবারের মতো বিদেশে । অনুভূতিটাই অন্যরকম । ভারত বাংলাদেশের চেয়ে আধাঘণ্টা পিছিয়ে । গিয়েই প্রথমে আধাঘণ্টা কমিয়ে নিলাম ।
যাহোক, ওখানে গিয়ে শুরুতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে আমাদের । যারাই আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে আসে তাদেরই দালাল মনে হয় । অনেক নাটক করে ওখানে থেকে ১০০ টাকায় পেলাম ৭৭.৮০ রুপী আর ১ ডলারে ৬৫ রুপী । ভাঙ্গিয়ে নিলাম কিছু ডলার আর টাকা । ওখানে সিমও বিক্রি হয়, কিন্তু আমরা সিম কিনেছি কলকাতা গিয়ে । এজন্য বেশ ভোগান্তিও গেছে আমাদের, আমার সেজন্য মনে হয় সিমটা বর্ডার থেকে নিলেও পারতাম । আমার অভিজ্ঞতা বলে টাকা বর্ডারে ভাঙ্গানোই ভালো । কলকাতায় আমরা সেভাবে সুবিধা করতে পারিনি । রেট কম বলে । দিল্লিতে তো টাকার রেট আরো কম । কেউ ভুল করেও দিল্লিতে টাকা ভাঙ্গানোর চিন্তা করবেন না । দিল্লিতে আমরা ১০০ টাকায় ৭৫ এবং ৭৬ রুপীর বেশি পাইনি । তবে ডলার যেকোন জায়গাতেই ভাঙ্গানো যায় । দিল্লিতে আমরা ডলার ভাঙ্গিয়েছি ৬৫.৩০ রুপীতে । কারো কাছে এই মাত্র কয়েক পয়সা বা ১/২ রুপীর জন্য এতো কথা বলা আধিক্য মনে হতে পারে । আপনি ব্যাপার টা তখনই বুঝতে পারবেন যখন বিশাল বড় অংকের বাংলা টাকাকে রুপীতে কনভার্ট করবেন ।
যাহোক, এরপর সেখানে থেকে অটোতে চেপে চলে সোজা চলে গেলাম বনগাঁ । তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে । সেখানে থেকে বনগাঁ লোকাল ট্রেনে চেপে চলে গেলাম শিয়ালদহ স্টেশনে । এই ট্রেন জার্নি টা মনে রাখার মতো ছিলো । বাংলাদেশে ঈদের সময় ট্রেনে যেমন ভিড় হয়, এখানে এই ট্রেনে সেইম এক্সপেরিয়েন্স । প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা সময় ধরে এরকম একটা নারকীয় জার্নি করতে হয়েছে । দুপুরের দিকে কলকাতা গিয়ে সবকিছু আণ্ডার কন্ট্রোল আনতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়েছে । প্রসঙ্গত, পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, লক্ষ্য যদি ফেয়ারলি প্লেস হয় তবে চেষ্টা করবেন বনগাঁ থেকে সকাল ৯ টা ৫০ মিনিটের মাঝেরহাট লোকাল ট্রেনটি ধরার । এই ট্রেন থেকে নামবেন বিবাদিবাগ স্টেশনে । আর সেখান থেকে ফেয়ারলি প্লেস কাছেই । আমরা যেহেতু বিলম্ব করেছি সেহেতু বাধ্য হয়েই আমাদের শেয়ালদহের টিকিট কাটতে হলো ।
শিয়ালদহ পৌঁছেই আগে দুপুরের খাওয়া সমাপন করি । এরপর নিউ মার্কেট থেকে সিম কার্ড কিনলাম (৩৫০+১৫০)= ৫০০ টাকা দিয়ে । সেখান থেকে সোজা ফরেইনারদের জন্য নির্ধারিত ফেয়ারলি প্লেস চলে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত কালকা অভিমূখী কালকা মেইলের টিকিট সংগ্রহের জন্য । গিয়ে দেখি ২২ তারিখের কোন টিকিট নেই এবং কলকাতা থেকে কালকা অভিমুখে কালকা মেইলে ফরেইনারদের জন্য সংরক্ষিত আসন হলো তিনটি । পড়ে গেলাম আরেক বিপদে । মানুষ চারজন কিন্তু সংরক্ষিত আসন তিনটি । অবশেষে কাউন্টারের ভদ্রমহিলা একটি উপায় বাতলে দিলেন । সেটি হলে সেই ট্রেনে চারজনের প্রথমে কলকাতা থেকে দিল্লি এবং এরপরে একই ট্রেনে দিল্লি থেকে কালকার টিকিট করে দিলেন । কলকাতা থেকে কালকার সরাসরি ভাড়া সম্ভবত ১০৫০ রুপীর মতো । কিন্তু আমাদের এরকম সিস্টেমে পড়লো ১১৭৫ রুপী । কি আর করার , একসাথে যাবার জন্য কয়টা রুপী বেশি দিতেই হলো । যাহোক, অবশেষে ২৩ তারিখ রাত ৭.৪০ এর কালকা মেইলের টিকিট হাতে পেয়ে সারাদিনের সকল শ্রান্তি ভুলে গিয়ে রিলাক্স হলাম । সেখানে এসির শীতল বাতাসে চারজন মিলে বসে থাকলাম অনেক্ষণ ।
যখন কলকাতার পথে নামলাম তখন বিকেল হয়ে এসেছে । এতোক্ষণ ট্রেনের টিকিটের অনিশ্চয়তার সংশয়ে কলকাতার পথে থেকেও কলকাতা নজরে পড়েনি । ট্রেনের টিকিট হাতে পেয়ে কলকাতাকে নতুন করে দেখা শুরু করলাম । ক্লান্তি দূর করতে চারজনে চা খেয়ে নিলাম ফুটপাতে দাঁড়িয়ে । ওদের চায়ের কাপগুলো মাটির তৈরি এবং ওয়ান টাইম ম্যাটেরিয়াল।
কলকাতার চায়ের কাপ
চা খেয়ে চারজনে অনেক্ষণ উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটির পরে হোটেল খুঁজতে বের হলাম । হোটেল খুঁজে পেতে এবার বেশ বেগ পেতে হলো । সুফল আর তাসিনকে দাঁড় করিয়ে আমি আর নিলয় খুঁজতে লাগলাম । খুঁজতে খুঁজতে সত্যি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম । অবশেষে অনেক কষ্টে নিউ মার্কেটের কাছে টটি রোডে একটা হোটেল পেয়ে গেলাম । চারজনে ৯০০ রুপী হিসেবে বেশ ভালোই ছিলো রুমটি ।
হোটেলে গিয়ে ব্যাগ&ব্যাগেজ রেখে বসতেই টের পেলাম সারাদিন কি ধকল গেছে সবার উপর দিয়ে । ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম চারজন । নিউ মার্কেটে গিয়ে ৩৫ রুপী বাটি গরুর মাংস আর ভাত দিয়ে ভাবমতো খেলাম চারজনে । ভারতে অন্যান্য আইটেমের তুলনায় বিফ আইটেমের মূল্যমান খুবই কম ।
দিল্লি আর কলকাতাতে যে চারদিন ছিলাম শুধুই বিফের উপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছি । মনে হচ্ছিলো আরো কয়দিন থেকে যাই শুধু বিফ খাওয়ার জন্যই । খাওয়া-দাওয়া শেষে হোটেলে ফিরে এসে চারজনে আজকের সারাদিনের ক্লান্তিকে বিদায় জানালাম ।
খরচঃ
ঢাকা-বেনাপোল (বাস) = ৫০০/-
বেনাপোল-কাস্টমস অফিস অটো ভাড়া = ১০/-
অফিসের প্রবেশ ফি = ৪২/-
ট্রাভেল ট্যাক্স = ৫০০/-
মোট = ১০৫২ টাকা
৭৭.৮০রুপী হিসেবে ১০৫২ টাকা = ৮১৮ রুপী
বর্ডার-বনগাঁ (অটো ভাড়া) = ৩০/-
বনগাঁ-শিয়ালদহ (লোকাল ট্রেন)= ২০/-
শিয়ালদহ দুপুরে খাওয়া = ৪৪/-
সিম ক্রয়(চারজনে ৫০০), জনপ্রতি = ১২৫/-
নিউ মার্কেট - ফেয়ারলি প্লেস(বাসে) = ১৩/-
কলকাতা-কালকা = ১১৭৫ /-
চা = ৬/-
হোটেল ভাড়া = ২২৫/-
রাতের খাবার = ৬০/-
অটো ভাড়া= ৭ /-
মোট = ২৫২৩ রুপী
No comments:
Post a Comment