কালকা অভিমুখে - (২৪-০৩-১৮)
ভোর বেলা যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন ট্রেন কলকাতা থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরের বিহারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো । ঘুম থেকে উঠে বাইরে তাকিয়ে পুরো অবাক হয়ে গেছি যখন দেখলাম অন্যান্যদের পাশাপাশি মধ্যবয়সী মহিলারা পর্যন্ত পাছার কাপড় তুলে একেবারে রেল লাইনের উপর দিয়ে বা এক থেকে দুই ফিট উঁচু হালকা কোন ঝোপের মধ্যে বসে মলত্যাগ শুরু করে দিয়েছে । ভোরের সূর্যালোক তাদের ক্ষণিকের জন্য অনাবৃত ফর্সা অংশগুলোতে পড়ে প্রতিফলন করছিলো এবং সেসব আলোক কণিকা খুব সহজেই অন্যান্যদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো । ট্রেন থেকে যে লোকজন তাদের দেখছে, সেই বিষয়ে তাদের কোণ বিকারই নেই । জীবনের অন্যতম ব্যতিক্রমী একটি অভিজ্ঞতা হিসেবে থেকে যাবে ঘটনাটা । যাহোক, এরপর ফের ঘুমিয়ে গেলাম । ঘুম ভাঙ্গলো দুপুরের আগে আগে । ক্ষুধা লেগে গেছে ।
ট্রেনে লাঞ্চ করি
ট্রেন থেকেই চারজন ৮০ টাকা হারে দুপুরের খাবার এবং ৪০ টাকায় একটি সফট ড্রিংকস কিনলাম । এভাবে ঘুম আর আড্ডাতেই কেটে গেলো পুরো দিনটি । মাঝখানে হালকা ক্ষুধা লাগলে নাস্তা তো ছিলোই সাথে । রাত এগারোটা নাগাদ ট্রেন দিল্লিতে গিয়ে থামলো । সেখানে প্ল্যাটফর্মে নেমে চারজনের রাতের খাবার কিনলাম । বলে রাখি, পারলে সাথে একটু রশি রাখবেন । এরকম লম্বা জার্নিতে শুকানোর জায়গার অভাবে সাধারণত কাপড় পরিষ্কার করার সুযোগ কমই মেলে বা ভেজা কাপড়ই ব্যাগে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় । সেক্ষেত্রে রাতে ঘুমানোর সময় ট্রেনে সামান্য একটু রশি টানিয়ে কাপড় শুকাতে দিতে পারেন । আর ইন্ডিয়ার ট্রেনে শুনেছি রাতে ব্যাগ হারায় । পারলে একটা চেইন লকার নিয়ে যাবেন । অথবা ওখানে প্ল্যাটফর্মেই অল্প দামে কিনতে পাবেন । যাহোক, ২৪ তারিখের কাহিনী এই "গোলাপী এখন ট্রেনে" টাইপ কাহিনীতেই কেটে গেলো ।
খরচঃ
দুপুরের খাওয়া = ৮০/-
সফট ড্রিংকস = ১০/-
রাতের খাবার = ৩০/-
মোট = ১২০/-
কালকা থেকে টয় ট্রেনে সিমলা - (২৫-০৩-১৮)
আমাদের কালকা মেইল ট্রেনটি হাওড়া থেকে ছাড়তে ৩ ঘণ্টা লেট করেছিলো । কিন্তু পথে বিরতিকাল স্বল্প করে আর তুলনামূলক জোরে টেনে সেই সময়টা পুষিয়ে ২৫ তারিখ ভোর ছয়টার দিকে কালকাতে পৌঁছায় । ট্রেনের লব্ধি বিলম্ব প্রায় শূণ্যের কাছাকাছি । কালকাতে নেমেই চলে গেলাম টিকিট কাউন্টারে । সেখানে থেকে মোট ২০০ টাকায় সিমলা অভিমুখী টয় ট্রেনের চারটি টিকিট সংগ্রহ করলাম । টিকিট নিয়ে ট্রেনের কাছে গিয়ে দেখি সেই ভীড় । অগত্যা বাধ্য হয়ে পরের ট্রেনে যেতে হলো । আমাদের টয় ট্রেন সাড়ে নয়টার দিকে কালকা ত্যাগ করলো ।
ট্রেনে ছাড়তেই সেই ফিল হচ্ছিলো । কত দিনের ইচ্ছে ছিলো এই ট্রেনে চড়ার । সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে অবশেষে । আমাদের পুরো ভ্রমণে টয় ট্রেনে ওঠার ব্যাপারটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হয়ে থাকবে । ট্রেন খুব ধীরে ধীরেই পাহাড়ের গা ঘেঁষে তৈরি লাইন ধরে এগোতে লাগলো । কালকা থেকে সিমলার দূরত্ব প্রায় ৯৬ কিলোমিটার । আমাদের এই পথটুকু অতিক্রম করতে সময় লাগলো প্রায় ছয় ঘণ্টা । ট্রেনে হালকা-পাতলা খাওয়া-দাওয়াও হলো । চারিদিকের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আর ক্ষুধার কথা সেভাবে মনেই আসেনি ।
ট্রেনটি টানেলে প্রবেশ করছে
পাহাড়ের গা ঘেঁষে ছুটে চলা টয় ট্রেন
ট্রেন থেকে তোলা নীচের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার চিত্র
বাড়ির ছাদে গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা
হিমাচল প্রদেশের বাড়িগুলো সব পাহাড়ের গা কেটে বানানো । সাধারণ সমতল ভূমি এলাকাগুলো থেকে আলাদা । বাড়িগুলোর অবস্থা দেখলেই এদের সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় মেলে । এরকম অসংখ্য বাড়ির ছাদ ভুমির সমান্তরালে অবস্থিত যেখানে গাড়িগুলো রাস্তা থেকে সরাসরি বাড়ির ছাদে পার্ক করা হয় ।
পথের সৌন্দর্যটা সত্যিই উপভোগ করার মতো ছিলো । এই পথে
পথের সৌন্দর্যটা সত্যিই উপভোগ করার মতো ছিলো । এই পথে
অসংখ্য টানেল পড়ে । টানেলের ভেতরে ট্রেন যখন প্রবেশ করে ট্রেনের ভেতরে তখন অন্ধকার হয়ে যায় । অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন সাঁকোও রয়েছে এই পথে । ইংরেজদের সময়ে বড় লাটরা এই ট্রেনে যাতায়াত করতেন । অসংখ্য গান এবং সিনেমার শ্যুটিংও হয়েছে এই ট্রেনে । এছাড়া পথিমধ্যে যে স্টেশনগুলোতে ট্রেন দাঁড়িয়েছিলো সবগুলোকে ট্রেনের মতোই খেলনা স্টেশন মনে হচ্ছিলো । প্রতিটি স্টেশনে ছোট্ট টিনশেড ছাউনির নীচে তিন সিটের দুই থেকে চারটি বেঞ্চ পাতা । সিমলায় পৌঁছেই দেখি স্টেশনে টয় ট্রেনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে একটি ছোটখাটো মিউজিয়াম বানিয়ে রেখেছে যেখানে ট্রেনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং ফটোগ্রাফ রয়েছে । ভালো লাগলো সংগ্রহগুলো দেখে ।
সিমলা-
সিমলায় যখন পৌঁছলাম তখন বিকেল প্রায় পাঁচটা বাজতে চলেছে । ট্রেন থেকে নেমেই ক্ষুধার অস্তিত্ব টের পেলাম । স্টেশনে নামার সাথে সাথে দালালরা ঘিরে ধরলো । এই ধরা সাধারণ ধরা না, জোঁকের মতো করে ধরা । আমি বরাবরই দালালদের এড়িয়ে চলেছি । সুতরাং এবারও এড়ানোর প্রচেষ্টায় কোন কমতি ছিলো না । আমাদের কথা হলো ক্ষুধা পেয়েছে, খাবার হোটেলে যাবো । তাদের কথা হলো আবাসিক হোটেল পাশেই, শুধু একনজর দেখে যাই যেনো । যে হোটেলেই ঢুকি সবার এক কথা – তারা সিমলা এবং মানালি মিলিয়ে একটা প্যাকেজ দেবে । আমরা যতই প্যাকেজের কথা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করি তারা ততই প্যাকেজের উপকারিতা বুঝাতে চেষ্টা করে আমাদের । তারা যতই বুঝায়, আমি ততই পিছলে যাই । আমি কোনদিনও কারো অধিক উপকারী দৃষ্টিভঙ্গি খুব ভালো চোখে দেখিনা । এবারও দেখলাম না । এভাবে ক্ষুধা পেটেই প্রায় তিন-চারটা হোটেল দেখলাম । এভাবে শেষপর্যন্ত আরেক দালাল দুই মিনিটের কথা বলে সাত মিনিট হাঁটিয়ে নিয়ে গেলো আরেক হোটেলে । আমার মেজাজ তখন প্রচণ্ড গরম । একেতো ক্ষুধা লেগেছে, দ্বিতীয়ত দালালদের পিছু ছাড়াতে পারিনা ।
যাহোক, অবশেষে ওনার মাধ্যমেই মাল রোডের কাছেই চারজনে ৯০০ টাকায় সুন্দর একটি হোটেল রুম পেয়ে গেলাম । হোটেলের লোকেশনটা অসাধারণ সুন্দর ছিলো । সেখানে থেকে সারা শহর টা খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছিলো ।
হোটেলে গিয়ে ব্যাগ&ব্যাগেজ রেখে দিয়ে খাবার হোটেলের উদ্দেশ্যে চারজন বের হলাম সিমলা শহরের পথে ।
সিমলাতে প্রবেশ করেই ভাস্কর্যটি চোখে পড়লো
হিমাচল প্রদেশের প্রতিষ্ঠাতা
বেশ ভালোই লাগছিলো শহরটা । ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে আর ক্ষুধাও অনেকটা মরে গেছে । তবুও ভালো কোন খাবারের হোটেল খুঁজে পেলাম না । টুকটাক পেলেও দাম অনেক বেশি । রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে সিমলার অনেকগুলো ট্রেডিশনার ফুড টেস্ট করলাম । খুব যে ভালো লেগেছে, ব্যাপার টা এমন নয় । কিন্তু একজায়গায় গেলাম, সেখানকার খাবারের সাথে পরিচয় থাকাটা দরকার তাই খাওয়া । কয়েকটি আইটেমের নাম বলছি – ভেজ মেমো, ছোলা পাঞ্চিয়া, কোকোনাট কুকিজ, স্যাণ্ডউইচ, লুচি ইত্যাদি । এসব খেয়েই জনপ্রতি ১২০ টাকা বিল উঠে গেলো । রাস্তায় সুন্দর সুন্দর সব মদের দোকান । আমাদের এক বন্ধুর আবার এসবের টুকটাক অভ্যাস আছে । বাংলাদেশের অনুপাতে এতো অল্প দামে এভাবে মদ বিক্রি করার ব্যাপার টা দেখে সে যে কি খুশি সেই পার্টনার ! দুই বোতল কিনলোও সে একাই । আমি অবশ্য ব্যাপারগুলো বরাবরই খুব বেশি অপছন্দ করি । ফুটপাতে দেখলাম অল্প দামে সুন্দর সুন্দর গায়ের চাদর বিক্রি করছে । প্রত্যেকেই দুইটা করে চাদর কিনলাম ওখানে থেকে যাতে বাড়িতে নিতে পারি । চাদরের মূল্য টা আমি লিস্টে দিলাম না । কারণ, এটা নিতান্তই ব্যক্তিগত খরচ এবং এভয়েড করার মতো । যাহোক, এভাবে রাত দশ-এগারোটা পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে হোটেল রুমে চলে এলাম । ততক্ষণে বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ে গেছে । হোটেলে ফিরে ফের আড্ডা মারতে মারতে ঘুম ।
খরচঃ
টয় ট্রেন ভাড়া = ৫০/-
ট্রেনে খাওয়া-দাওয়া= ২৫/-
হোটেল ভাড়া = ২২৫/-
রাতে ট্রেডিশনাল ফুড = ১২০/-
মোট = ৪২০ রুপী
No comments:
Post a Comment